সংকটের সমাধানে ব্যর্থ GCC শিখর সম্মেলন

কাতারের আমীর রিয়াধে আয়োজিত গালফ কর্পোরেশন কাউন্সিল – GCC’র ৩৯তম শিখর সম্মেলনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রায় দেড় বছর ধরে চলা উপসাগরীয় সংকট নিরসনের আশা বিনষ্ট হল। এই সম্মেলনে কাতারের প্রতিনিধিত্ব করেন সেদেশের বিদেশ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী সুলতান বিন সাদ অল-মুরাইখি। উল্লেখ্য, এই সংকট নিরসনের আশায় GCC’র ২০১৮’র সভাপতি সুলতান সলমান বিন আবদল্লা আজিজ অল-সৌদ ব্যক্তিগত চিঠি পাঠিয়ে কাতারের আমীরকে শিখর সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।  GCC বার্ষিক সম্মেলন সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং সেই সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। এটি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সবচেয়ে সফল অর্থনৈতিক মঞ্চ যা সদস্য দেশগুলির অর্থনৈতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০১৭’য় উপসাগরীয় সংকট শুরু হওয়ার পর এর দুটি শিখর সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার ফলে   GCC’র ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। এ বছরের শিখর সম্মেলনে স্থিতিশীলতা এবং ঐক্যের আহ্বান জানানো হলেও তা ফলপ্রসূ হয় নি।

ভৌগলিক, অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে থাকায় বিশেষ করে বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে GCC’তে সৌদি আরবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এদিকে,অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক বিকাশের প্রেক্ষিতে কাতার এবং সম্মিলিত আরব আমীরশাহীর স্বতন্ত্র বিদেশনীতি প্রণয়নের প্রয়াস লক্ষনীয় হয়ে উঠছে। ইরান ও সন্ত্রাসবাদ সহ অধিকাংশ আঞ্চলিক বিষয়ে সম্মিলিত আরব আমীরশাহী এবং সৌদি  আরব একমত হলেও কাতার এবিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করছে। বিশেষ করে তিউনিশিয়া, মিশর, ইয়েমেন, লিবিয়ার মতো আরব দেশগুলিতে ‘আরব বসন্ত’ বা ইসলামকে রাজনীতির মূল হিসেবে তুলে ধরার পরে এটি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কাতার এবং তুরস্ক ‘ইসলামীয় প্রজাতন্ত্রবাদ’এর সমর্থক মুসলিম ব্রাদারহুড অফ মিশরের মতো গোষ্ঠীর অন্যতম সমর্থক হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে এটি সৌদি আরব এবং আরব আমীরশাহীর স্বার্থের পরিপন্থী হওয়ায় তারা সম্পূর্ণ উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং তাদের শাখাগুলিকে নিশ্চিহ্ন করতে সচেষ্ট। মিশরে ২০১৩ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থিত রাষ্ট্রপতি মোরসিকে ক্ষমতাচ্যুত  করার পর সামরিক অধিগ্রহণের সময় সৌদি আরব এবং সম্মিলিত আরব আমীরশাহীর সঙ্গে কাতারের এই বিরোধ আরো প্রকট হয়ে ওঠে।

সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ইরান প্রসঙ্গেও মতপার্থক্য রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ইরানের ক্রমবর্ধমান সামরিক ও রাজনৈতিক উপস্থিতি কাতারের স্বার্থের পরিপন্থী। অন্যদিকে, সৌদি আরব, সম্মিলিত আরব আমীরশাহী এবং বাহরিন মনে করে ইরান সম্প্রসারণবাদী এবং এই সংকটজনক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। ইরান হিজবুল্লা এবং হৌথি বিদ্রোহীদের মত শিয়াপন্থী জঙ্গিদের সমর্থন করছে। ইরাক ও সিরিয়ায় এদের সামরিক উপস্থিতি, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বিস্তারের উচ্চাকাঙ্খার প্রমাণ। ‘ইসলামীয় বিপ্লব’কে  অন্যান্য আরব দেশগুলিতে দেওয়ার প্রসারিত করার আহ্বানের ক্ষেত্রে তেহেরানের ভূমিকাকে সৌদি আরব এবং শরিক দেশগুলি সন্দেহের চোখে দেখে এবং তারা ইরানের বিরুদ্ধে উপসাগরীয় দেশগুলিকে ঐক্যবদ্ধ  করতে আগ্রহী। ওমান ও কুয়েত ছাড়া GCC’র অন্যান্য সদস্যরা ইরানের সঙ্গে কাতারের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের প্রেক্ষিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।

ভারতের কাছেও এই সংকট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগ আকর্ষণ ও সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় লক্ষ্যে ২০১৪ থেকে নতুন দিল্লি উপসাগরীয় দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।  GCC ভারতের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অংশীদার এবং শক্তি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। GCC ‘র মধ্যে ভাঙ্গন দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের দেশগুলির সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক বিঘ্নিত হতে পারে। তবে এই সংকট GCC’র অভ্যন্তরীন সমস্যা এবং আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করতে হবে বলে ভারত মনে করে। এই সংকটের দ্রুত সমাধান সম্ভব হবে এবং  GCC’র সঙ্গে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হবে বলেও ভারত আশা করছে।

( মূল রচনাঃ ডঃ মহম্মদ মুদাস্‌সীর কোয়ামার )